ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

২৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৩ রমজান ১৪৪৬

কফিনবন্দি হয়ে শেষবার এফডিসিতে এলেন অঞ্জনা

বিনোদন প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রকাশ: ১৬:৫৬, ৪ জানুয়ারি ২০২৫ | আপডেট: ১৭:০৩, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

কফিনবন্দি হয়ে শেষবার এফডিসিতে এলেন অঞ্জনা

পাঁচ দশক আগে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের যে জায়গাটি কিশোর অঞ্জনা রহমানকে বানিয়েছিলেন নায়িকা, সেই এফডিসিতে কফিনবন্দি হয়ে শেষবারের মত এলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই অভিনেত্রী। শনিবার বেলা সোয়া ১১টায় অভিনেত্রীর মরদেহবাহী গাড়িটি প্রবেশ করে চলচ্চিত্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন-বিএফডিসির ভেতরে।

সেখানে অঞ্জনাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পরিচালক ছটকু আহমেদ, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, শিল্পী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য ও অভিনেতা সনি রহমানসহ চলচ্চিত্র ও অভিনয় জগতের অনেকে।

ওই সময় অঞ্জনার ছেলে নিশাত রহমান মনি বলেছেন, বাদ জোহর এফডিসিতে জানাজা শেষে অভিনেত্রীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে। সেখানে আরেকবার জানাজা হয়েছে এই নায়িকার। এরপর নানী কবরস্থানে অঞ্জনার দাফন হবে বলে জানিয়েছেন মনি।

মায়ের অসুস্থতা নিয়ে মনি বলেন, ‘আম্মু সুস্থ ছিল, জ্বর আসত আবার চলে যেত। ১৫ দিন আগে বাসায় মেহমান এসেছিল সবাইকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে। তারপরই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ জ্বর ভেবে ওষুধ খাচ্ছিল, হাসপাতালে যেতে চাইত না। অসুস্থতা বাড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আমি কখনো বুঝতেই পারিনি আম্মুর ভেতরে এমন অসুস্থতা ছিল। এমন সুস্থ একজন মানুষের ভিতরে এতটা অসুখ কীভাবে বাঁধল!’

অঞ্জনার মৃত্যুতে মিডিয়া অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক ও শ্রদ্ধা  জানিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীসহ মিডিয়া অঙ্গনের অনেকেই।

অঞ্জনার মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপারস্টার শাকিব খান লিখেছেন, ‘অঞ্জনা ম্যাডামের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।’ অভিনেত্রী জয়া আহসান লিখেছেন, ‘শান্তিতে থাকুন কিংবদন্তি অভিনেত্রী অঞ্জনা রহমান ম্যাডাম।’

অভিনেতা মিশা সওদাগর লিখেছেন, ‘কিংবদন্তি বাংলাদেশি চিত্রনায়িকা অঞ্জনা আপা আর নেই। আমার শোক জানানোর কোনও ভাষা নেই। দোয়া করবেন।’ পূজা চেরী লিখেছেন, ‘ভেতরটা ধুঁক করে উঠল। ভালো থাকবেন আপনি যেখানেই থাকুন।’

আশনা হাবীব ভাবনা লিখেছেন, ‘আপনার আত্মা শান্তি পাক। আপনার স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে সারাজীবন জ্বলজ্বল করবে। বিদায় সুপারস্টার।’  

জায়েদ খান লিখেছেন, ‘কত স্মৃতি আপনার সাথে, কীভাবে ভুলবো? না ফেরার দেশে চলে গেলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র শিল্পী অঞ্জনা সুলতানা। তার জন্য দোয়া কামনা করছি।’

নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিক লিখেছেন, ‘না ফেরার দেশে চলে গেলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র শিল্পী অঞ্জনা রহমান। শোক ও শ্রদ্ধা আপনার জন্য।’

নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইসে, লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইসে... আশা ফুরানোর আগেই আপনার জীবন ফুরিয়ে গেলো! নয়ন জুড়ানোর আগেই আপনার নয়ন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো! আপনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমার বাবার পরিচালিত ‘জিঞ্জির’, ‘আনারকলি’ ও ‘অংশীদার’-এই তিন তিনটি সুপারহিট চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হয়ে আপনি ছিলেন আমার বাবা-মায়ের অতি আপন তথা আমাদের পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরপর আমার কর্মজীবনে কতশত অনুষ্ঠানে আপনার সাথে দেখা হওয়া, একসাথে কাজ করার সৌভাগ্য হওয়া, সবই স্মৃতি হয়ে গেলো! কোনও মৃত্যুই কাম্য নয়! কিন্তু প্রবীণ হয়েও এত উচ্ছল, চঞ্চল, আনন্দদায়ক নবীন প্রাণের অকালপ্রয়াণ মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টকর! এরকমই প্রাণোচ্ছল কাটুক পরপার জীবন।’

ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে তার ১টা ২০ মিনিটে অঞ্জনা রহমান মারা যান। সত্তর ও আশির দশকের ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই অভিনেত্রীকে বুধবার রাত থেকে হাসপাতালে ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই অঞ্জনা চলে যান না ফেরার দেশে।

এফডিসিতে অঞ্জনাকে শ্রদ্ধা জানাতে আরো ছিলেন অভিনেত্রী পলি আক্তার, রোমানা ইসলাম মুক্তি, জয় চৌধুরী, নৃত্য পরিচালক ইউসুফ খান, শ্রাবণ সাহাসহ আরো অনেকে।

ঢাকায় এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে অঞ্জনার জন্ম। ছোটবেলা থেকে নাচের প্রতি তার আগ্রহের কারণে বাবা-মা তাকে নাচ শিখতে ভারতে পাঠান। সেখানে তিনি ওস্তাদ বাবুরাজ হীরালালের কাছে নাচের তালিম নেন, শেখেন কত্থক।

সিনেমায় আসার আগেই অঞ্জনা পরিচিতি পান নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ১৯৭৬ সালে বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘সেতু’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ঢাকাই সিনেমায় কাজ শুরু করলেও তার মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ছিল শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’।

নায়ক সোহেল রানার বিপরীতে ওই সিনেমার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি অঞ্জনাকে। নিজের সেরা সময়ে ঢাকাই সিনেমার প্রথম সারির প্রায় সব নায়কের বিপরীতেই অভিনয় করেছেন তিনি।

নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে তাকে দেখা গেছে ৩০টি সিনেমায়, যার মধ্যে রয়েছে ‘অশিক্ষিত’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘আশার আলো’, ‘জিঞ্জির’, ‘আনারকলি’, ‘বিধাতা’, ‘বৌরানী’, ‘সোনার হরিণ’, ‘মানা’, ‘রামরহিমজন’, ‘সানাই’, ‘সোহাগ’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ও ‘অভিযান’এর মত দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র।

এছাড়া ভারতের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী; পাকিস্তানের অভিনেতা ফয়সাল, নাদীম, জাভেদ শেখ, ইসমাইল শাহ; নেপালের শীবশ্রেষ্ঠ ও ভুবন কেসির সঙ্গেও অভিনয় করেছেন এই নায়িকা।

চার দশকের ক্যারিয়ারে শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন অঞ্জনা। ‘গাংচিল’ সিনেমার জন্য ১৯৮২ সালে এবং ‘পরিণীতা’ সিনেমার জন্য ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পাশাপাশি তিনবার বাচসাস এবং নৃত্যে দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

১৯৯২ সালের পর থেকে সিনেমায় অনিয়মিত হয়ে যান অঞ্জনা। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তার সর্বশেষ সিনেমা ‘ভুল’।

আরও পড়ুন