ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

২৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৪ রমজান ১৪৪৬

হামাস-ফাতাহ’র বৈরিতা: সূচনা-উপসংহার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১২:০৮, ৩০ নভেম্বর ২০২৪ | আপডেট: ১৯:০৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

হামাস-ফাতাহ’র বৈরিতা: সূচনা-উপসংহার 

ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ চলছে বেশ কয়েক দশক ধরে। সম্প্রতি ইসরায়েলে হামাসের হামলা, জবাবে গাজায় ইসরায়েলের লাগাতার পাল্টা হামলার ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।

হামাস ও ফাতাহ’র আত্মপ্রকাশ 

ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ বা প্রথম ইন্তিফাদার মধ্য দিয়ে হামাসের আবির্ভাব হয় ১৯৮৭ সালে। ‘হামাস’ নামটি এসেছে আরবি ভাষায় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ইসলামী গোষ্ঠীর মধ্যে হামাস সবচেয়ে বড় সংগঠন। এক সময় হামাস মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপর ১৯৯১ সালে মোহাম্মদ দেইফের নেতৃত্বে হামাসের মিলিশিয়া বা সশস্ত্র বাহিনী, আল কাসাম ব্রিগেড প্রতিষ্ঠিত হয়। মোহাম্মদ দেইফ ছিলেন ওই ব্রিগেডের কমান্ডার। হামাস হল ইসলামের সুন্নি অনুসারীদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী যাকে ইরানসহ বিভিন্ন দেশ সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন কার্যক্রম বিবেচনায হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেছে ইসরায়েল এবং পশ্চিমা শক্তি।

আজ থেকে ১৬ বছর আগে গাজা উপত্যকা থেকে ফাতাহকে হটিয়ে দেয়ার পর গাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে হামাস। এরপর থেকেই গাজা উপত্যকায় অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। সেখানে পণ্য ও সাধারণ মানুষের চলাচল সীমিত করতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফাতাহ হল, ফিলিস্তিনের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। এই দলটি পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধান চালিকা শক্তি। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ঠিক এক দশক পর ১৯৫৯ সালে ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতসহ সেখানকার আন্দোলন কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় পিএলও।

শুরুর দিকে ফাতাহ সশস্ত্র উপায়ে ইসরায়েলি সরকারের বিরোধিতা করলেও পরে দলটি ১৯৮০-এর দশকে কূটনৈতিক উপায়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করে। যা শেষ পর্যন্ত অসলো চুক্তিতে গড়ায় অর্থাৎ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। যদিও ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল হামাস।

হামাস-ফাতাহ’র ভিন্নতা কোথায় 

আপাতদৃষ্টিতে দুটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য একটি একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা, তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই ভিন্ন। ফাতাহ ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নম্বর প্রস্তাবনার পক্ষে সম্মতি জানায়। অন্যদিকে হামাস ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না। বরং এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি তাদের ১৯৮৮ সালের প্রতিষ্ঠা সনদে বর্তমান ইসরায়েলসহ ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। 

ফাতাহ নিজেদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। এজন্য তারা ইসরায়েলিদের সাথে আলোচনা করতে পারে সেইসাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিতে পারে। যেখানে কিনা হামাস ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছে।

দ্বন্দ্ব যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে

ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল ২০০৭ সালের জুন মাসে। সে সময় গাজা উপত্যকায় হামাস এবং ফাতাহর লড়াইয়ে বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফাতাহ হেরে যায়। শুরু হয় হামাসের রাজত্ব। হামাস যোদ্ধারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এই সহিংসতা শুরু হয়। এই সশস্ত্র সংঘাত, ‘গাজার যুদ্ধ’ নামেও পরিচিত। এই লড়াই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এত গভীর বৈরিতা সৃষ্টি করেছিল যে সেই সংঘাতের চিহ্ন আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ওই সংঘাতের ফলে ফিলিস্তিনের যৌথ সরকারের বিলুপ্তি ঘটে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে শাসনভার ভাগ হয়ে যায়। ফিলিস্তিনের দুই অংশ- পশ্চিম তীর ফাতাহ আর গাজা হামাসের শাসনে চলে যায়।

কেন এবং কি ছিল আলোচিত ‘অসলো চুক্তিতে’ 

১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হই ইয়াসির আরাফাত, আইজ্যাক রবিন এবং বিল ক্লিনটন উপস্থিতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল ‘অসলো চুক্তির’ সময় থেকেই। আলোচিত এই অসলো চুক্তিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে অস্থায়ী শান্তি চুক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। যার বর্তমানে সভাপতিত্ব করছেন মাহমুদ আব্বাস।

অসলো চুক্তির মাধ্যমেই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার কিছু অংশের উপর সীমিত কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। একই সময়ে চুক্তিটি পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং নির্বাসনে থাকা অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের দেশে ফেরার অনুমতিও প্রদান করে। কিছু ভিন্ন দর্শন রয়েছে আসলো চুক্তি ঘিরে। অনেকেই এই চুক্তিকে একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তি অর্জনের সূচনা হিসেবে দেখেছেন এবং এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

হামাসসহ যারা এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল তারা মনে করে, এই চুক্তির মাধ্যমে ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।‘ এর ফলে হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে ওঠে যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

দ্বিমুখী মতাদর্শের চর্চা 

ওয়াশিংটন ডিসির, আরব সেন্টারের, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল কর্মসূচির প্রধান ইউসেফ মুনায়ার বলেছেন, এই দুটি দল ‘বিশ্বকে ঘিরে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। সেইসাথে মতাদর্শ ও জনমত ঘিরেও তাদের মতভিন্নতা রয়েছে। ২০০৭ সালের মার্চে, ইসমাইল হানিয়া এবং মাহমুদ আব্বাস একটি ঐক্য সরকার গঠন করেন যা সফল হয়নি। নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করতে না পারার পেছনে এই দুই দল একে অপরকে দোষারোপ করে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজা থেকে শুরু হওয়া সহিংস হামলার বিরোধিতা করেছেন ফাতাহ নেতারা। এ কারণে হামাসের মনে করে, ফিলিস্তিনের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একটি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ প্রতিনিধি। মুনায়ার বলেন, ‘সমস্যা হল দুইটা গোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নমত রয়েছে এবং মৌলিক পার্থক্যগুলো বেশ প্রকট।’

এদের আচরণ এতটাই বিরোধপূর্ণ, যে কারও কারও ধারণা ফাতাহ ‘ইসরায়েলিদের নিরাপত্তা দেয়ার ঠিকাদারি নিয়েছে’ কারণ এতদিনেও কোন সুনির্দিষ্ট ফলাফল না দেখে তারা হতাশ। তারা মনে করে যে ইসরায়েলের সাথে আলোচনার ফলে ফিলিস্তিনের লাভ কিছুই হয়নি বরং ইসরায়েল তাদের দখল চালিয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, তারা হামাসকে সন্ত্রাসীদের গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচনা করে। 

অর্থ ও অস্ত্রের সংঘাতে হামাস-ফাতাহ 

এক কথায় শত্রুতা মানেই হল ’অর্থ এবং অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে রয়েছে’, এটাই মূলত ক্ষমতার মূল ভিত্তি। হামাস-ফাতা ‘র মধ্যকার এ্ই শত্রুতা একদিনের নয় বরং কয়েক দশক ধরেই চলে আসছে। রাজৈনৈতিকভাবে  যথেষ্ট সম্ভবনা থাকার পরও তারা অনেক জনপ্রিয় সমর্থন হারিয়েছে কারণ কোন দলই দীর্ঘমেয়াদী কোন সমাধান আনতে পারেনি। যার ফলে উভয় দলই ক্রমশ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে যা তাদের কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। এই কারণেই ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে ফাটল দীর্ঘায়িত হয়েছে। 

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও অবসান হয়নি দুই পক্ষের বৈরিতার। হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে এই বৈরিতা বা দ্বন্দ্ব ফিলিস্তিনের স্বার্থকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে।

পরিস্থিতি জটিল কারণ একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, কারা আসলে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব করছে। নাথান ব্রাউন ব্যাখ্যা করেছেন, ‘দুই দলের এই বিভক্তি ফিলিস্তিনিদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তারা কাকে দোষারোপ করবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেটা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে।’

ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ এই দেখে হতাশ যে তারা তাদের প্রত্যাশা এখনও অর্জন করতে পারেনি, না কূটনৈতিক উপায়ে না সশস্ত্র উপায়ে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অচলাবস্থার কারণে হামাস তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে মানুষের ব্যাপক সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল, অন্তত গাজায় তারা অনেক সমর্থন পায়।

আরও পড়ুন