ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

২৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৪ রমজান ১৪৪৬

কোথায় থামবে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮:৩১, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

কোথায় থামবে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’

নতুন বাংলাদেশ, নতুন বিচারব্যবস্থা। ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে গড়তে চেয়েছে এ দেশ। এই দেশের নতুন শাসকদের দিতে হবে শহীদদের রক্তের প্রতিদান। বিচারের নামে আর যেন প্রহসন না হয়। সবকিছু আমূলে বদলে যাবে সেই প্রত্যাশা,বদলাবে কি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’?

বাংলাদেশে চার ধরনের বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একটি তো প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা। যেখানে আইন আছে, আদালত আছে। যেখানে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তদন্ত হয়, আদালতে বিচার হয়, দুই পক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক, সাক্ষ্যপ্রমাণে বিচার হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা যায়, রিভিউ করা যায়। এমনকি সব বিচার শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা যায়। রাষ্ট্রপতি চাইলে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিকেও মার্জনা করতে পারেন।

বাংলাদেশের এ বিচার ব্যবস্থা খুবই মানবিক। প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যায় না। এ বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো, এ ব্যবস্থায় দশ জন অপরাধী মুক্তি পেয়ে যাক, কিন্তু কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়। কিন্তু এ চমৎকার বিচার ব্যবস্থাকে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। দলীয়করণ, দীর্ঘসূত্রতা, অর্থ আর প্রতিপত্তিতে প্রভাবিত করা, মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষ্য, একজনের সাজা আরেকজনের খাটা- সব মিলিয়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। অন্য সব ঠিক হলেও দীর্ঘ মামলাজট কমানো সহজ নয়। বিচারবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থায় সেখানে একদম উল্টো। কাউকে সন্দেহ হলেই হলো। বিচার, রায় এবং তা কার্যকর হয় রকেটগতিতে। সকালে আটক, রাতে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান এবং এক গুলিতেই বিচার শেষ। নিজের ওপর এলে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন বটে, তবে সাধারণ ভাবে এই রকেটগতির বিচারবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের প্রবল আস্থা। ক্রসফায়ারের পর কোনো কোনো এলাকায় মিষ্টি বিতরণের খবরও ছাপা হয় পত্রিকায়।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে তথ্যপ্রাপ্তির মূল উৎসে। প্রতিটি সংবাদমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপুল ব্যবহারকে কাজে লাগিয়ে সংবাদ দ্রুততম সময়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও বর্তমানে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে প্রত্যক্ষদর্শীরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধে তথ্য প্রচার করে থাকেন, যেগুলো অতি অল্প সময়ে ছড়িয়ে পরার মতো ঘটনাও প্রায়শই ঘটে।

গণমাধ্যম, বিচারবিভাগ ও ন্যায়বিচার– তিনটি বিষয় একটি আরেকটির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। ধরুন, একটি অপরাধ সংঘটিত হলো। এখন গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে সেই অপরাধের তথ্য অবিকৃত অবস্থায় মানুষের কাছে প্রকাশ করা। এতে মানুষজন সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবে, সচেতন হতে পারবে। আবার একই অপরাধের অভিযোগ যখন আদালত তথা বিচার বিভাগের সামনে উত্থাপিত হবে, তখন আদালত তথা বিচার বিভাগের দায়িত্ব হচ্ছে কোনো পূর্বানুমান ছাড়াই নিরপেক্ষভাবে অপরাধের বিচার সম্পন্ন করা৷ আদালত এক্ষেত্রে কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারবে না, কোনো পক্ষকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারবে না। আবার যে ব্যক্তিরা একটি মামলায় দু’পক্ষে অবস্থান করেন, তারা প্রত্যেকেই ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবিদার।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মামলা কিংবা কোনো বিশেষ মামলার ক্ষেত্রে জনমনে তুমুল আগ্রহ থাকে। গণমাধ্যম এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মামলার বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করতে থাকে। যেহেতু গণমাধ্যমের প্রকাশ করা তথ্যানুযায়ী একটি ঘটনার ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি হয়, ফলে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই গণমাধ্যমের কারণে ‘দোষী’ সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তার প্রতি মানুষের এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, যেন তিনিই অপরাধটি করেছেন।

আমাদের দেশের যেকোনো অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে যে আইনগত দর্শন অনুসরণ করা হয়, সেটি হচ্ছে– অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগপর্যন্ত একজন ব্যক্তি নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হবে (Innocent until proven guilty)। অর্থাৎ গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত কথাই বলা হোক না কেন, আদালতের সামনে একজন ব্যক্তি ‘দোষী’ সাব্যস্ত হওয়ার আগে তিনি নির্দোষ। কিন্তু গণমাধ্যমে যদি একজন অভিযুক্ত বা অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা হয়, তখন সেভাবেই জনমত গড়ে ওঠে। চারদিক থেকে গণমাধ্যম যেভাবে দেখিয়েছে, সেভাবে রায় ঘোষণার দাবি উঠতে থাকে। কোনোক্রমে যদি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশিত রায় দেয়া না হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি গণমাধ্যমেও বিচারকের তুমুল সমালোচনা করা হয়৷ এর ফলে বিচারক প্রচন্ড চাপের সম্মুখীন হন। এভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিচার বিভাগের উপর গণমাধ্যমের এই অযাচিত প্রভাব বিস্তারই মূলত ‘মিডিয়া ট্রায়ালের প্রধান নেতিবাচক দিক।

গণমাধ্যম আর বিচার বিভাগ একটি দেশের গণতন্ত্র ঠিক রাখার জন্য পাশাপাশি কাজ করে যায়। গণমাধ্যম সত্যটা মানুষের সামনে তুলে আনে, আর আদালত সত্য প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। এই দুটি কখনোই একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। গণমাধ্যমের অযাচিত প্রভাবে যেন বিচার বিভাগ বিচারকাজ সম্পাদনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয়, সেটি লক্ষ্য রাখা অতীব জরুরি। জনগণের আগ্রহ কাজে লাগিয়ে কোনো ঘটনা অন্যভাবে উপস্থাপন করলে দিনশেষে ন্যায়বিচারই ব্যাহত হবে।

বাংলাদেশে স্পর্শকাতর বিভিন্ন ঘটনায় সন্দেহভাজনদের আটকের পরপরই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করানোর বিষয়টি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গণমাধ্যম অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে বিচারের আগেই অভিযুক্তরা জনমনে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান।

এধরণের ঘটনা মানবাধিকারের লঙ্ঘন উল্লেখ করে তাঁরা বলেছেন হাইকোর্টেরও নির্দেশনা রয়েছে গ্রেফতার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোন ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির না করা হয়। কিন্তু স্পর্শকাতর অনেক মামলাতেই সন্দেহভাজনদের আটক করা হলে তাদের ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই।

আরও পড়ুন